বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর এক বিলিয়নেরও বেশি বজ্রপাত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাতের প্রকোপ ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রতি ডিগ্রি বৃদ্ধির সাথে এটি শতকরা প্রায় ১২ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাবে এমনকি ২১০০ সাল নাগাদ শতকরা ৫০ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
একটি মাত্র বজ্রপাত পরিবেশের উপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে- দাবানলের সূত্রপাত করতে পারে এবং বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটাতে পারে, বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যাহত করতে পারে, প্রচুর পরিমাণে NOx এবং ওজোন উৎপন্ন করতে পারে। বজ্রপাতের ঝলকনি আকাশ জুড়ে ভয়ানক আলোর খেলা দেখায় (চিত্র নং-১)।
চিত্র নং- ১: বজ্রপাতের আলোর ঝলকানি
মাঠে-ঘাটে কৃষক ও শ্রমিকরা বা অন্যান্য কাজের জন্য যারা বাইরে থাকেন তারা বজ্রপাতের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতিহাসের আলোকে বোঝা জরুরি- কীভাবে এই বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে হবে এবং বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।
কেমন করে বজ্রপাতের জন্ম হয়?
বজ্রপাত হতে হলে চারটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। যেমন- বর্ধিত তাপ এবং আর্দ্রতা, শক্তিশালী আপড্রাফ্ট, চার্জ তৈরি এবং বৈদ্যুতিক নিঃসরন। উষ্ণ তাপমাত্রার ফলে বাষ্পীভবন বৃদ্ধি পায় এবং বায়ুমণ্ডলীয় আর্দ্রতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটি পরিবাহী বিশাল মেঘ গঠনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে, যা বজ্রঝড় এবং বজ্রপাতের জন্ম দেয়।
বাতাসের বর্ধিত আর্দ্রতা উচ্চ তাপমাত্রার সাথে মিলিত হয়ে বজ্রঝড়ের মধ্যে আরও শক্তিশালী আপড্রাফ্টের সৃষ্টি করে । বর্ধিত বজ্রঝড়ের মধ্যে জলের ফোঁটা এবং বরফের স্ফটিকগুলির শক্তিশালী চলাচল এবং সংঘর্ষ স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, যা চার্জের পৃথকীকরণের পথকে উন্মুক্ত করে। যখন বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন বজ্রপাত ঘটে- আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা দেয়।
বজ্রপাতের ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকেই বজ্রপাতের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাসে। মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সৃষ্টিতে উল্লেখ আছে বজ্রপাতের ভয়াবহতা। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দার্শনিক থ্যালিস একটি শুকনো কাপড় দিয়ে অ্যাম্বারের টুকরো ঘষেছিলেন এবং উল্লেখ করেছিলেন যে, এটি পালক এবং খড়কে আকর্ষণ করে।
১৫০০ শতকের শেষের দিকে রানী এলিজাবেথের রাজদরবারের নিরাময়কারী উইলিয়াম গিলবার্টও অ্যাম্বার ব্যবহার করেছিলেন। তিনি এর নামকরণ করেছিলেন ইলেকট্রিকা- না জেনেই তিনি স্থির বিদ্যুৎ প্রদর্শন করছিলেন।
আধুনিক যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। ফলে বজ্রপাত নিয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে দেখা যাওয়া ৮২৯ কিমি দীর্ঘ বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা দিয়েছিল পূর্ব টেক্সাস থেকে ক্যানসাস সিটির কাছাকাছি পর্যন্ত, যা প্যারিস এবং ভেনিসের মধ্যে দূরত্বের সমান।
সবচেয়ে লম্বা সময় নিয়ে যে বজ্রপাতটি তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল তা হলো ১৭.১০২±০.০০২ সেকেন্ড এর। এটি দেখা গিয়েছিল ১৮ জুন ২০২০ তারিখে উরুগুয়ে এবং উত্তর আর্জেন্টিনায়। আর একটি মাত্র বজ্রপাতের আঘাতে ২১ জন লোক মারা যাওয়র রেকর্ডটির স্থান হলো জিম্বাবুয়ে, যা ঘটেছিল ১৯৭৫ সনে।
বজ্রপাত কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে?
বিশেষ করে ২০শ শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে প্রতি বছর বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়, গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াসে বজ্রপাতের হার প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা বৃষ্টিপাত এবং পরিবাহী উপলব্ধ সম্ভাব্য শক্তির কারণে ২১০০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যত বেশি বৃষ্টির মেঘ, তত বেশি পরিচলন এবং তত বেশি বজ্রপাতের সৃষ্টি । আরেকটি কারণ হল বায়ু দূষণ। বাতাস যত বেশি নোংরা হবে, তত বেশি বজ্রপাত হবে।
বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুহার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বজ্রপাতের কারণে অনেক মানুষ মারা যায়; বনে আগুন লেগে প্রাণী ও গাছপালা ধ্বংস হয়। যেমন ধরুন, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ২০০০-৩০০০ লোক মাঠে-ঘাটে কাজ করতে গিয়ে মারা যায় বজ্রপাতের কারণে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মাঠে কাজ করতে গিয়ে ২০১০ থেকে ২০২০ সন পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩২৭৩ জন লোক মারা যায়।
বিভিন্ন ধরনে সম্পদও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বজ্রপাত থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে। যেমন- বনে আগুন লাগা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং পাওয়ার গ্রিডের ব্যাপক ক্ষতি হওয়া বনে আগুন লেগে কীরকম কষতি হবে পারে তা চিত্র নং- ২ এ দেখানো হলো।
তদুপরি বজ্রপাতের কারণে জলাশয়েও দুর্ঘটনা ঘটে। তবে কত লোক মারা যায় এই বিষয়ে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জলাশয়গুলোতে জলপ্রবাহের পরিবর্তন ও জলস্তর কমে যাওয়ার ঘটনা দেখা যায়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
চিত্র নং- ২: আগুন লেগে বনের ক্ষতি, মার্কিন যুক্তরাস্ট্র
এশিয়া মহাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ইতিহাস ও পরিসংখ্যানের ধারণা
এখানে যে তথ্যগুলো দেখানো হলো তা ১০০ ভাগ সঠিক নয়। কারণ সঠিক ও আপডেটেড ডেটা সংগ্রহে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকায় মৃত্যুর সংখ্যাগুলি আনুমানিক ও ধারনামূলক। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন গবেষণাপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে এই ধারনা তৈরী করা হয়েছে।
(১) সময়কাল ১৯০০-১৯৫০
এই সময়ে বৈজ্ঞানিক রেকর্ড ও তথ্যের অভাব থাকায়, বিশেষত এশিয়ায়, বজ্রপাতে মৃত্যুর নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা কঠিন। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার (যেমন, আন্তর্জাতিক দুর্যোগ তথ্য কেন্দ্র, EM-DAT) রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সময়ে বজ্রপাতের কারণে প্রতি বছরে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এশিয়ার কৃষি-নির্ভর সমাজ ও খোলা আকাশের নিচে কাজ করা মানুষজনের জন্য এই সংখ্যা বেশি।
(২) সময়কাল ১৯৫০-২০০০
ধারনা করা হয় যে, এই সময়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫,০০০ থেকে ২৪,০০০ মানুষের মৃত্যু হত বজ্রপাতে; যার একটা বড় অংশ এশিয়ায়। আনুমানিকভাবে এই সময়ে এশিয়ায় বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৭ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে।
(৩) সময়কাল ২০০১ থেকে ২০২৫
অতীত তথ্যের ভিত্তিতে এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বজ্রপাতের বিরোদ্ধে সতর্কতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়ছে। এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমে আসার প্রবণতা দেখা গেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে।
অনুমান করা হয় যে, ২০০১ থেকে ২০২৫ এর মধ্যে বজ্রপাতের কারণে বছরে গড় মৃত্যুর সংখ্যা ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০। এই সময়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক ১.৫ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ। তবে ২০২১-২০২৫ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে।
প্রতিরোধের উপায় ও সমাধান
বজ্রপাত প্রশমনের মধ্যে রয়েছে ঘরের বাইরের এবং ঘরের ভিতরের উভয় কৌশল, সেইসাথে কাঠামোগত সুরক্ষা। যদি আপনি বাইরে থাকেন তবে বজ্রপাতের সময় তাৎক্ষণিকভাবে একটি বড় ভবন বা শক্ত ধাতব যানবাহনে আশ্রয় নিন। আর যদি খোলা জায়গায় থাকেন, তাহলে মাটিতে নিচু হয়ে বসে যান। ঘরের ভিতরে থাকলে জল, তারযুক্ত ফোন এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এড়িয়ে চলুন। শেষ বজ্রপাত হওয়ার পরও কমপক্ষে ৩০ মিনিট একইভাবে থাকুন।
বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বজ্রপাত প্রতিরোধের কিছু কার্যকর উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
(ক) বজ্রপাত প্রতিরোধক ব্যবস্থা: বজ্রনিরোধক (Lightning Rod) স্থাপন। এটি ভবন বা খামারে স্থাপন করে বজ্রপাতের ক্ষতি কমানো যায়।
(খ) সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: মাঠে কাজ করা শ্রমিক ও কৃষকদের বজ্রপাতের সময় কি করবেন তা শেখানো। যেমন, খোলা স্থানে থাকলে দ্রুত আশ্রয় নেওয়া, বিদ্যুতের সংস্পর্শ এড়ানো ইত্যাদি।
(গ) প্রাকৃতিক উপায়: গাছ লাগানো, শুকনো স্থানে অবস্থান করা, ইত্যাদি।
(ঘ) নিয়মিত আবহাওয়া পূর্বাভাস জানা: আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বজ্রপাতের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে বাইরে না যাওয়া বা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া যায়।
(ঙ) সরকারি ও স্থানীয় উদ্যোগ: বজ্রপাত প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
FAQs
বজ্রপাত কখন হয়?
সাধারণত বজ্রপাত ঘটে মৌসুমী ঝড়ের সময়, বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে।
বজ্রপাতের সময় কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?
খোলা জায়গায় থাকলে দ্রুত ঘরে যান, উচ্চ স্থানে থাকবেন না, এবং বজ্রপাতের সময় পানিতে যাবেন না।
বজ্রপাতের ক্ষতি কী কী হতে পারে?
বৈদ্যুতিক শক, অগ্নিকান্ড, গাছের ক্ষতি, ভবন ধ্বংস ও মানুষের মৃত্যু হতে পারে। সারা জীবনের জন্য স্নায়বিক ক্ষতি হবে।
বজ্রপাতের ফলে কি ধরনের বৈদ্যুতিক শক হতে পারে?
মারাত্মক বা জীবনঘাতী শক হতে পারে, যা হঠাৎ মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
এশিয়ায় বজ্রপাতের রাজধানী কোনটি?
সিঙ্গাপুর
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ৩০-৩০ নিয়ম কি?
বিদ্যুতের ঝলকানি দেখার পর বজ্রপাতের শব্দ না শোন পর্যন্ত সময় গণনা করতে হবে। ৩০ সেকেন্ড বা তার কম হলে বজ্রপাত বিপজ্জনক হবে- আশ্রয় খুঁজুন। বজ্রপাতের পরে আশ্রয়স্থল ত্যাগ করার আগে ৩০ মিনিট বা তার বেশি অপেক্ষা করুন।
পৃথিবীতে এমন কোন জায়গা আছে কী যেখানে প্রায় সারা বছর বজ্রপাত হয়?
হ্যাঁ আছে। ভেনেজুয়েলার ক্যাটাটাম্বো নদীর আশেপাশের এলাকা যেখানে নদীটি মারাকাইবো হ্রদে প্রবাহিত হয়। এখানে বছরের প্রায় ২৬০ রাত্রিতে বজ্রপাত হয়।
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের বৃদ্ধির সমস্যা সমাধানে বিশ্ব ও দেশের পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগের প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলায় সচেতনতা ও প্রযুক্তির সহায়তা অপরিহার্য। আমাদের অবশ্যই বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেতনতা বাড়াতে হবে, প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে করে আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব।