ভেজাল/নকল ওষুধ: প্রতারণার ফাঁদ, বিপদ এবং প্রতিকারের উপায়

Category: Health & Wellness | Tags: No tags

Author: Jatish Chandra Biswas | Published on: September 22, 2025, 9:49 a.m.


গাজীপুরের আর্দ্র বাতাস, বাজারের কোলাহল, শিশুর কাশি ও গোঁঙাণির শব্দে ভারী হয়ে আছে ছোট একটি ফার্মেসির পরিবেশ যেখানে রিণা নামের এক তরুণী মা অ্যান্টিবায়োটিকের একটি প্যাকেট আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। 

তার কোলের ছোট শিশুটি অবিরাম কাশছে, শরীরে জ্বর। মা বিশ্বাস করে যা কিনে খাওয়াচ্ছিলো তা তার শিশুকে আরোগ্য করতে পারছে না। যে ঔষধ  সে তার শিশুকে খাওয়াচ্ছিলো তা ছিল একটি ভেজাল ঔষধ- দেখতে প্রায় আসল ওষুধের মতো (চিত্র নং- ১), প্রায় নিখুঁত প্যাকেট!

চিত্র নং- ১নকল ও ভেজাল ওষুদের মধ্যে পার্থক্য 

 

যত দিন যাচ্ছিল রিনার ছেলে তত দুর্বল হচ্ছিল। কাশি আরও গভীর হয়েছিল ও জ্বর বেড়ে গিয়েছিল। তিনি হতাশ হয়ে আরেকজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করেন- যিনি সন্দেহের বসে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করfন। 

ভয়াবহ সত্যটি হলো, রিনা যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলি শিশুকে খাওয়াচ্ছিল ছিল নকল। জীবন রক্ষাকারী যৌগের পরিবর্তে সেখানে ছিল চক পাউডার এবং জড় পদার্থের মিশ্রণ। এটি ছিল নকল ওষুধের ছলনাময় জগৎ যা  দুর্বলদের শিকার করে এবং বিশ্বাসের ভিত্তি ভেঙে ফেলার একটি অন্ধকার জগৎ।

প্রথিবীতে যে পরিমাণ ওষুধ নকল হয় তার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের স্থান হলো প্রথম। বিশ্বব্যাপী নকল ওষুধের মধ্যে শতকরা ২৮ ভাগ হলো অ্যান্টিবায়োটিক নকল। দুঃখের বিষয় হলো যে, শতকরা ৭৮ ভাগ নকল অ্যান্টিবায়োটিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসে এবং তাদের গন্তব্যস্থল মূলত উদীয়মান দেশগুলি। যেমন- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া শতকরা ৪৪ ভাগ, সাব-সাহারান আফ্রিকা শতকরা ৩০ ভাগ, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা: শতকরা ৯ ভাগ এবং বাকী অংশ অন্যান্য দেশের জন্য প্রযোজ্য (চিত্র নং-২)

চিত্র নং-২: নকল অ্যান্টোবায়োটিকের বাজার 

 

যেভাবে নকল বা ভেজাল করা হয় তা হলো তথাকথিত অ্যান্টেবায়োটিকের বেলায় সক্রিয় উপাদান নেই শতকরা ৪৩ ভাগ ওষুধের, খারাপ মান শতকরা ২৪ ভাগ ওষুধের, অপর্যাপ্ত সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ শতকরা ২১ ভাগ ক্ষেত্রে, ভুল সক্রিয় উপাদান দেয়া হয় শতকরা ৭ ভাগ এর বেলায় এবং জাল প্যাকেজিং হয় শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রে)।

ভেজাল বা নকল ওষুধ খেয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যায় এবং সাধারণ সংক্রমণ জ্বর থেকে বিপজ্জনক নিউমোনিয়ায় পরিণত হয় বা দুর্বল রোগী মারা যায়। অন্যান্য ওষুধেও নকল বা ভেজাল হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। লোভী মানুষের চিন্তা শুধু টাকা কামাতে- মানুষ মরে যাক তাতে কি আসে যায়!

প্রথমে রিনাকে নিয়ে যে গল্পটি বলা হয়েছে তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে। বাংলাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে নকল ওষুধের বাজার সমৃদ্ধ হচ্ছে, যা পরিশীলিত অপরাধী নেটওয়ার্ক এবং ছিদ্রযুক্ত সরবরাহ শৃঙ্খল দ্বারা ইন্ধনপ্রাপ্ত। এর পরিণতি সুদূরপ্রসারী। 

এমন অবস্থা কেবল মাত্র ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের উপরই নয়, জাতীয় অর্থনীতি এবং বৈধ ওষুধ প্রস্তুতকারকদের সুনামের উপরও প্রভাব ফেলছে। তবুও তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না এদেশে। ধনী ও ক্ষমতাবানরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়। তাই গরীবের ভোগন্তি বা মৃত্যু দিয়ে কষ্টের পরিসমাপ্তি হয়!

 

নকল/ভেজাল ওষুধ কীভাবে ক্ষতি করছে?

নকল বা ভেজাল ওষুধ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো কার্যকরী না হওয়ায় রোগ নিরাময় হয় না। পাশাপাশি এগুলো শরীরে বিষাক্ত উপাদান জমা করে। ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগের পরিস্থিতি আরো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে এবং জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

চিকিৎসা ব্যর্থতা

সবচেয়ে তাৎক্ষণিক বিপদ হল অসুস্থতার চিকিৎসায় ব্যর্থতা। সংক্রমণ আরও খারাপ হয়, দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং জীবন-হুমকিস্বরূপ রোগগুলি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই অগ্রসর হয়।

বিলম্বিত এবং ভুল চিকিৎসা

রোগীদেরকে নকল ওষুধ খাওয়ানো ফলে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। এতে অসুস্থতা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বৃদ্ধি এবং উচ্চ মৃত্যুর হার হতে পারে। বিশেষ করে শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।

প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া 

কিছু নকল ওষুধে ক্ষতিকারক পদার্থ, শিল্প রাসায়নিক, বা সক্রিয় উপাদানের ভুল ডোজ থাকে, যা বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া, অঙ্গহানি, রোগের আরো হওয়া এবং এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু

নকল অ্যান্টিবায়োটিকগুলিতে প্রায়শই সক্রিয় উপাদান উপ-থেরাপিউটিক ডোজ থাকে বা কোন সক্রিয় উপাদান থাকেনা । এই অপর্যাপ্ত এক্সপোজার ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ব্যাকটেরিয়া যখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যায় তখন অতিরিক্ত মাত্রা কিংবা তার চেয়ে উন্নতর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়। তবে তা যদি না থাকে তবে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এমন অবস্থা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করছে। 

মানসিক প্রভাব

নকল বা ভেজাল ওষুধ মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষন্নতা সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো শরীরের রাসায়নিক ব্যালান্স বিঘ্নিত করে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়- চিন্তা ভাবনা অস্পষ্ট হয় এবং মনোযোগ কমে যায়। প্রতারিত হওয়ার এই উপলব্ধি স্বাস্থ্যসেবার উপর আস্থাহীনতা, আর্থিক ক্ষতি ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং সমাজকে একটি গভীর ক্ষতির দিকে পরিচালিত করতে পারে।

পরিত্রাণের উপায় কী?

ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে একযোগে বিভিন্ন স্তরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, মানসম্পন্ন উৎপাদন, জনসচেতনতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার এ সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপদ থাকবে এবং ভেজাল ওষুধের প্রভাব কমে আসবে।

অনন্য ডিজিটাল শনাক্তকরণ

ট্রো মার্কার প্রতিটি আসল ওষুধের প্যাকে একটি অনন্য ও সুরক্ষিত ডিজিটাল পরিচয় প্রদান করে। এটি একটি QR কোড, একটি NFC ট্যাগ, অথবা অন্য কোনও উন্নত মার্কার হতে পারে। এদেশেও তাৎক্ষনিকভাবে যাচাইয়ের ব্যবস্থা আছে। তবে তা গ্রহণ করার মানসিকতা না থাকলে কিছেউ হবে না।

গ্রাহকরা তাদের স্মার্টফোন ব্যবহার করে মার্কারটি স্ক্যান করতে পারেন এবং একটি নিরাপদ ডাটাবেসের বিরুদ্ধে পণ্যের সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করতে পারেন। এটি সচেতন ক্রেতাদের জন্য একটি যুৎসই প্রযুক্তি যা দিয়ে নকল ওষুধ ক্রয় এড়াতে সক্ষম হন।

সাপ্লাই চেইন স্বচ্ছতা

এই ডিজিটাল মার্কারগুলি উৎপাদন কারখানা থেকে ফার্মেসির তাক পর্যন্ত সরবরাহ শৃঙ্খলে ট্র্যাক করা যেতে পারে। এটি ভেজাল ওষুধের ফাঁস এবং অনুপ্রবেশের সম্ভাব্য পয়েন্টগুলি সনাক্ত করার জন্য মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে।

বর্ধিত ট্রেসেবিলিটি 

সন্দেহভাজন ভেজাল ওষুধের ক্ষেত্রে ডিজিটাল মার্কার দ্রুত এবং সঠিকভাবে এর উৎপত্তিস্থলের সন্ধান করতে দেয়, তদন্তে সহায়তা করে এবং বাজার থেকে নকল পণ্য অপসারণ করতে সাহায্য করে।

ভোক্তা সম্পৃক্ততা এবং সচেতনতা

ট্রো মার্কারের সাথে যুক্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি ভোক্তাদের আসল পণ্য, নকল ওষুধের সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ রিপোর্ট করার উপায় সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারে।

কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রণয়ন

সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা। ওষুধ উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রির উপর কড়া নজরদারি চালাতে হবে। অবৈধ ও ভেজাল ওষুধ বিক্রির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা

ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। তদারকি সংস্থাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে যাতে তারা দ্রুত ও কার্যকরভাবে ভেজাল ওষুধ শনাক্ত করতে পারে।

বিক্রির স্থান নিয়ন্ত্রণ

ওষুধের অনুমোদিত দোকান ও ফার্মেসির সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের উপর নজরদারি জোরদার করতে হবে। অননুমোদিত দোকান ও ফার্মেসি বন্ধ করে দিতে হবে এবং অবৈধ বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

ভেজাল ওষুধ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সংগঠন ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো দরকার। ট্রেড মার্শাল, তথ্য বিনিময় ও যৌথ অভিযান চালানো যেতে পারে।

 

FAQs

ভেজাল ওষুধ কীভাবে চিহ্নিত করবেন?

মানসম্পন্ন ওষুধের প্যাকেটের গুণমান, উৎপাদন তারিখ ও মেয়াদ দেখে যাচাই করুন। অনুমোদিত দোকান থেকে কিনুন।

 

ভেজাল ওষুধের ফলে কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে?

অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি, বিষক্রিয়া, রোগের অবনতি, এমনকি জীবন হুমকির আশঙ্কা থাকে।

 

ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে আমরা কীভাবে সচেতন হতে পারি?

অনুমোদিত দোকান থেকে কেনা, প্যাকেটের হালনাগাদ তথ্য দেখা ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের পরামর্শ নেওয়া।

 

ভেজাল ওষুধের প্রতিকার কী?

দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

 

কেন মানুষ ভেজাল ওষুধ কিনে থাকেন?

কম দামে পাওয়া যায়, সহজলভ্যতা ও অবহেলার কারণে।

 

সরকার ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে?

নিয়মিত অভিযান, তদন্ত, ফৌজদারি ব্যবস্থা এবং সচেতনতা কর্মসূচি চালানো।

 

ভেজাল ওষুধের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কী করতে হবে?

গণমাধ্যম, স্কুল, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রচার চালানো এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।

 

উপসংহার

ভেজাল বা নকল ওষুধ একটি মারাত্মক প্রতারণার ফাঁদ। এগুলো মানসম্পন্ন ওষুধের মতো দেখাতে প্রচুর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু মনে রাখেতে হবে, এতে ক্ষতিকর উপাদান থাকে বা কার্যকারিতা নেই। ভেজাল ওষুধ গ্রহণ শরীরের জন্য বিপজ্জনক- অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে, বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে এবং রোগের অবনতি ঘটায়।

এমন অবস্থ থেকে রক্ষা পেতে হলে বিশ্বস্ত ও অনুমোদিত ওষুধের দোকান থেকে কেনাকাটা করতে হবে, প্যাকেটের তথ্য যাচাই করতে হবে ও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সচেতনতা বাড়িয়ে এবং নিয়মিত অভিযান চালিয়ে ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।