বায়ু দূষণ ও আমরা: পারকিনসন্স রোগের ভয়ংকর থাবা ও আমাদের করণীয়

Category: Science & Environment | Tags: No tags

Author: Jatish Chandra Biswas | Published on: September 11, 2025, 5:05 a.m.


বিশ্বের প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে বাতাসের মান স্বাস্থ্যকর মাত্রার চেয়ে অনেক নিচে চলে গেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলো যেমন, ঢাকা, কলকাতা, নয়া দিল্লি, কাঠমান্ডু অতিরিক্ত দূষণের কারণে এই পরিস্থিতির শিকার। 

দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব শুধুমাত্র শ্বাসযন্ত্রের জন্য নয়, বরং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ক্ষেত্রেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে । অনেক জটিল রোগের মধ্যে পারকিনসন্স রোগটি অন্যতম যা মানুষের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ নষ্ট করে দেয় (চিত্র নং- ১)।

চিত্র নং- ১: পারকিনসন্স রোগী 

 

সম্প্রতি ৫ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের উপর করা একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, দূষিত বায়ু সংস্পর্শে এল এক ধরণের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা আলঝাইমার রোগ এবং ভাস্কুলার ডিমেনশিয়ার পরে তৃতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

পারকিনসন্স রোগের পরিচিতি

পারকিনসন্স মূলত একটি স্নায়ু ক্ষয়কারি রোগ, যা মস্তিষ্কের ডোপামিন উৎপাদনকারী নিউরন ধ্বংসের মাধ্যমে দেখা দেয়। এর ফলে শরীরের গতি ধীর হয়ে যায়, কমে যায় স্বাভাবিক চলাফেরা, বেড়ে যায় দেহের কাঁপুনি, কঠিনতা এবং সমন্বয়হীনতা। এই রোগের প্রকৃত কারণ এখনো সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি, তবে গবেষণায় দেখা গেছে পরিবেশগত কারণের পাশাপাশি জেনেটিক ফ্যাক্টরও এই রোগ হওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখে। 

 

পারকিনসন্স রোগের লক্ষণ কী?

দই ধরনের পার্কিনসন রোগ আছে। ফলে এদের লক্ষণও ভিন্ন হয়ে থাকে। ডিমেনশিয়া ছাড়া পার্কিনসন রোগে কাঁপুনি এবং ধীর গতি, ঘুমের সমস্যা এবং বিষণ্ণতার মতো লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে, ডিমেনশিয়া সহ পার্কিনসন রোগে স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ, সমস্যা সমাধান এবং যোগাযোগের উপর প্রভাব ফেলে এবং মানুষের জীবনকে অথর্ব করে দেয়। 

ডিমেনশিয়াবিহীন পার্কিনসন রোগের রোগীদের ফ্রন্টাল লোবে ধূসর পদার্থের পরিমাণ কমে যায় (চিত্র নং- ২)। তবে, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত পার্কিনসন রোগের রোগীদের অক্সিপিটাল লোবের ধূসর পদার্থ উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।

চিত্র নং ২: পারকিনসন্স রোগীর ও সুস্থ্য মানুষের মাথার অবস্থা; ক) পার্কিনসন্স রোগ/লিউই বডি সহ ডিমেনশিয়া বনাম ডিমেনশিয়াহীন পার্কিনসন্স রোগ; খ) ডিমেনশিয়াহীন বর্ধিত পর্যায়ে পার্কিনসন্স রোগ বনাম সুস্থ্য মানুষের মস্তিস্ক। নীল রঙের অঞ্চলগুলি এদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ বা গঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নির্দেশ করছে। 

 

পারকিনসন্স রোগ কেমন করে হয়?

আঠালো আলফা-সিনুক্লিন প্রোটিন উৎপাদনের জন্য দায়ী জিন SNCA-এর দ্বিগুণ বা তিন গুণ বৃদ্ধি পেলে  পারকিনসন রোগ দেখা দেয়। বংশগতি এক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। SNCA-এর অতিরিক্ত অনুলিপি অধিক আলফা-সিনুক্লিন প্রোটিন তৈরি করে, যা মস্তিস্কেরর স্নায়ু ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে এবং পারকিনসনের লক্ষণগুলির তীব্রতা বৃদ্ধি করে।

 

দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর উপাদান ও তার প্রভাব

বাতাসে থাকা নানা ক্ষতিকর উপাদান যেমন, অণুকণা (Particulate Matter), নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, অর্গ্যানিক ভেষজ যৌগ, ইত্যাদি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে PM2.5 কণা এতটাই ছোট যে, এটি সহজে ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। 

গবেষণায় দেখা গেছে, PM2.5 কণা মস্তিষ্কের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে ডোপামিন নিউরন ধ্বংসের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং পারকিনসন্সের মতো  জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

বাতাসে PM2.5 এর ঘনত্ব বেশি এমন অঞ্চলে বসবাস করলে ডিমেনশিয়াহীন পার্কিনসন'স রোগীর তুলনায় লিউই বডি ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। উদাহরনস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অঞ্চলে বাতাসে PM2.5 এর ঘনত্ব বেশি সেখানে ডিমেনশিয়াসহ বা ডিমেনশিয়াহীন পার্কিনসন'স রোগীর সংখ্যা অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে (চিত্র নং- ৩)।

চিত্র নং- ৩: মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের বাতাসে অনুকণাার উপস্থিতি এবং পারকিনসন্স রোগীর সংখ্যা, ২০০০-২০১৪

 

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, PM2.5 হরমোনের পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল অক্ষকে সক্রিয় করতে পারে। ফলে এটি স্নায়বিক এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণগুলো মধ্যে একটি। এছাড়াও, PM2.5 এবং অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা এবং বিপাকের মধ্যে একটি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা অন্ত্র-মস্তিষ্ক অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করে (আরো জানতে, Li et al. 2022)।

 

দক্ষিণ এশিয়ায় দূষণের প্রকৃতি ও পরিস্থিতি

দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের এক অন্যতম দূষিত অঞ্চল। এই অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব, শিল্পায়ন, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জ্বালানি ও কাঠের ধোঁয়া, আবর্জনা জ্বালানি, ইত্যাদি মিলিয়ে বাতাসের মান দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। 

বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ু দূষণকারী ১০টি শহরের মধ্যে নয়টিই দক্ষিণ এশিয়ায়। কয়েকটি হটস্পট চিত্র নং- ৪ এ দেখানো হলো। এই অঞ্চল সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র। তবে এ অঞ্চলের বাতাসে PM 2.5 এর ঘনত্ব WHO কর্তৃক নির্ধারিত মানের চেয়ে ২০ গুণ বেশি (৫ µg/mᶾ)। ফলে প্রতি বছর এই অঞ্চলে আনুমানিক ২০ লক্ষ লোকের অকাল মৃত্যু ঘটে। 

চিত্র নং- ৪: দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি প্রধান এয়ারশেড যেখানে সূক্ষ্ম দূষণ কণার ঘনত্ব, ভূ-প্রকৃতি এবং উৎস অঞ্চলের মধ্যে পরিবহন দেখানো হয়েছে 

 

দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি শহরের পিএম২.৫ মান

দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শহরগুলিতে PM2.5 এর মাত্রা বিভিন্ন সময় ও বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। তবে তা অনেক শহরেই WHO এর নির্দেশিত ৫ µg/m³ এর চেয়ে বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে দিল্লি এবং কলকাতার মতো শহরগুলিতে বার্ষিক গড় PM2.5 ঘনত্ব ছিল যথাক্রমে ১১০ µg/m³ এবং ৮৪ µg/m³ (চিত্র নং- ৫)। 

২০২৩ সালের স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার রিপোর্টের তথ্য অনুসারে একই শহরগুলির বাতাসের গড় PM2.5 মান ছিল দিল্লিতে ২৫.৬ µg/m³ এবং কলকাতায় ২০.২ µg/m³। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক শহরগুলোর বায়ুর মানও স্থাস্থ্যসম্মত নয়।

চিত্র নং- ৫: দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে পিএম২.৫ এর পরিমাণ

 

প্রতিকার ও রোধের উপায়

ব্যক্তিগত পর্যায়ে

  • মাস্ক ব্যবহার করুন (বিশেষ করে PM2.5 এর ঝুঁকি থাকলে)
  • বাইরে বের হলে কম সময় থাকুন বা দূষিত পরিবেশ এড়িয়ে চলুন
  • পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখুন

 

পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ

  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন
  • ধূমপান ও ধোঁয়া থেকে বিরত থাকুন
  • ঘরে থাকলে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করুন

 

সমাজ ও সরকারের উদ্যোগ

  • বায়ু মানদণ্ডের কঠোর প্রয়োগ ও কঠোর আইন
  • শিল্প-কারখানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর নিয়ম আরোপ করতে হবে
  • সবুজায়ন ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বন ধ্বংস করা যাবে না
  • শিক্ষা ও সচেতনতা মূলক প্রচার বাড়াতে হবে
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দূষণের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে

 

প্রযুক্তিগত সমাধান

  • বাতাস পরিশোধন প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে হবে
  • পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন (স্মার্ট যানবাহন, সৌর ও বিদ্যুৎচালিত যানবাহন)
  • শিল্পের দূষণ নিয়ন্ত্রণ

 

সরকারের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী নীতিমালা ও জনসচেতনতা জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারকে কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। 

এছাড়া, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমানোর উদ্যোগে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন:

  • বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রকাশ
  • দূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড গ্রহণ
  • পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ

 

ভবিষ্যতৎ পরিকল্পনা

দূষণ মোকাবেলায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জনসচেতনতার সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। ধীরে ধীরে পরিবেশের দিকে মনোযোগ বাড়িয়ে, সবুজায়ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতার মাধ্যমে পারকিনসন্সের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

সাধারণ মানুষ, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমাদের নিজেদের জীবন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।

 

প্রশ্নোত্তর

পারকিনসন্স রোগ কী?  

এটি একটি স্নায়ুর ক্ষয়কারি বা কর্মক্ষমতা কমাজনিত রোগ। ডোপামিন নিঃসরণ কমে যাওয়ায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকলাপ ব্যাহত হয়।

 

দূষিত বাতাসের কোন কণা সবচেয়ে ক্ষতিকর?  

PM2.5 (আনবীক্ষনিক কণার আকার 2.5 মাইক্রোমিটারের নিচে) সবচেয়ে ক্ষতিকর, কারণ এগুলো মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং পাকিনসন্স রোগ তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

 

দক্ষিণ এশিয়ায় বাতাসের মান কতটা বিপজ্জনক?  

বেশিরভাগ শহরে বাতাসের মান স্বাস্থ্যকর মানের নিচে রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

 

দূষিত বাতাস পারকিনসন্সের ঝুঁকি বাড়ায় কীভাবে?  

বাতাসের কণা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে ডোপামিন নিউরন ধ্বংসের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এর ফলে রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

 

পারকিনসন্স রোগের প্রতিকার কি সম্ভব?  

এখনো সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়, তবে উপসর্গ কমানোর জন্য ও ঝুঁকি কমানোর উপায় রয়েছে।

 

প্রাকৃতিক উপায় কি দূষণের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে?  

হ্যাঁ, উদাহরণস্বরূপ, গাছ লাগানো, আর্দ্রতা বজায় রাখা, ইত্যাদি।

 

পারকিনসন্সের জন্য কোন বয়সে ঝুঁকি বেশি?  

সাধারণত ৬০ বছর পর ঝুঁকি বেশি। তবে বাতাসের দূষণের কারণে কম বয়সেও ঝুঁকি বাড়তে পারে।

 

দূষিত বাতাসের অন্য কোন কোন রোগের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?  

হাঁপানি, হৃদরোগ, ক্যান্সার, নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ ইত্যাদির সম্পর্ক রয়েছেছ।

 

প্রজননক্ষমতা ও বায়ু দূষণের সম্পর্ক কী?  

গবেষণায় দেখা গেছে যে, দূষিত বাতাস প্রজনন ক্ষমতা কমাতে পারে।

 

উপসংহার

দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু শ্বাসযন্ত্রের জন্য নয়, বরং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের জন্যও গভীর বিপদ ডেকে আনে। দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তবে সচেতনতা, প্রযুক্তি, ও সরকারের কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব, দূষণ থেকে মুক্ত জীবন গড়ার।