নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুঃ জীবন চক্র

Category: Space & Astronomy | Tags: Space Exploration

Author: Jatish Chandra Biswas | Published on: August 27, 2025, 1:09 a.m.


জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে মহাবিশ্বে এক সেপ্টিলিয়ন (১ এর পর ২৪টি শুন্য দিতে হবে) পর্যন্ত নক্ষত্র থাকতে পারে। আমাদের মিল্কিওয়েতে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি নক্ষত্র রয়েছে; যার মধ্যে আমাদের সবচেয়ে সুপরিচিত নক্ষত্র হলো সূর্য।

নক্ষত্রগুলি হল উত্তপ্ত গ্যাসের বিশাল বলসমূহ। অবশ্য আমাদের পরিচিত ফুটবলের আয়তন দিয়ে নক্ষত্রের সাথে তুলনা করা যাবে না। নক্ষত্রের বেশিরভাগ অংশই হলো হাইড্রোজেন। এ ছাড়া আছে কিছু  পরিমাণে হিলিয়াম এবং নগন্ন পরিমাণে অন্যান্য উপাদান। প্রতিটি নক্ষত্রের নিজস্ব জীবনচক্র আছে, যা কয়েক মিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন বছর পর্যন্ত হতে পারে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদের বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবর্তিত হয়।

 

নক্ষত্রের জন্ম

গ্যাস এবং ধুলোর বিশাল মেঘ দিয়ে নক্ষত্র তৈরি হয়, যাকে বলে আণবিক মেঘ। আণবিক মেঘের ভর সূর্যের ভরের চেয়ে ১,০০০ থেকে ১ কোটি গুণ বেশি এবং শত শত আলোকবর্ষ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকতে পারে। আণবিক মেঘ ঠান্ডা যার ফলে গ্যাস জমাট বাঁধে এবং উচ্চ ঘনত্বের স্থান বা পকেট তৈরি করে।

আনবিক মেঘগুলির মধ্যে কেউ কেউ একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে বা আরও পদার্থ সংগ্রহ করতে পারে। তাদের ভর বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের মহাকর্ষীয় শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং অবশেষে শক্তির ভিন্নতার কারণে মেঘগুলির কেউ কেউ ভেঙে পড়ে।

উপরে উল্লিখিত এরকম ঘটনা যখন ঘটে তখন ঘর্ষণের ফলে তাদের উপাদানগুলি উত্তপ্ত হয়ে একটি প্রোটোস্টার বা একটি শিশু তারকার জন্ম দেয়। আণবিক মেঘ থেকে সম্প্রতি তৈরি হওয়া নক্ষত্রের সমষ্টিকে স্টেলার ক্লাস্টার বলা হয়। স্টেলার ক্লাস্টারে পূর্ণ আণবিক মেঘগুলিকে বলা হয় স্টেলার নার্সারি  (ছবি নং- ১)।

ছবি নং- ১: ক্যারিনা নেবুলার উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত NGC 3324 নামক একটি স্টেলার নার্সারির প্রান্ত পর্বত এবং উপত্যকা তৈরি করেছে।

উৎস: NASA, ESA 

 

নক্ষত্রের জীবনযাপন

প্রথমে প্রোটোস্টারের বেশিরভাগ শক্তি আসে তার প্রাথমিক পতনের ফলে নির্গত তাপ থেকে। লক্ষ লক্ষ বছর পর নক্ষত্রের কেন্দ্রে প্রচণ্ড চাপ এবং তাপমাত্রা হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একত্রিত করে হিলিয়াম তৈরি করে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন। নিউক্লিয়ার ফিউশনের ফলে যে শক্তি নির্গত হয় তা নক্ষত্রকে উত্তপ্ত করে এবং গ্র্যাভিটেশনাল বলের প্রভাবে এটিকে আবার ভেঙে পড়া থেকে বিরত রাখে।

যে সকল নক্ষত্র ধারাবহিকভাবে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়ার ফিউশনের মধ্য দিয়ে হিলিয়াম তৈরি করে তাদেরকে  জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা  প্রধান ক্রম নক্ষত্র বলে থাকেন। এটি একটি নক্ষত্রের জীবনের দীর্ঘতম পর্যায়। এই পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ বা বিলিয়ন বছর ধরে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা, আকার এবং তাপমাত্রা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। আমাদের সূর্য তার প্রধান ক্রম পর্যায়ের প্রায় মাঝামাঝি রয়েছে এবং মাঝে মাঝে সৌর শিখা নির্গত করছে (ছবি নং- ২)।

 

ছবি নং- ২: নাসার সোলার ডায়নামিক্স অবজারভেটরিতে তোলা এই ছবিতে সূর্যের শক্তিশালী সৌর শিখা নির্গত হওয়া ধরা পড়েছে।

উৎস: NASA/SDO

 

গ্যাস হলো নক্ষত্রের জ্বালানি। আর এর ভর নির্ধারণ করে এটি তার গ্যাস সরবরাহের মধ্য দিয়ে কত দ্রুত জীবনের শেষ প্রান্তে চলে যাবে। তবে কম ভরের নক্ষত্রগুলি খুব বৃহৎ নক্ষত্রের তুলনায় দীর্ঘ সময় ধরে ম্লান এবং শীতলভাবে জ্বলতে থাকে।

অধিক বৃহৎ নক্ষত্রগুলিকে তাদের নিজস্ব ওজনের ভারে নিচের দিকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা উৎপন্ন করার জন্য উচ্চ হারে জ্বালানি পোড়াতে হয়। উচ্চ হারে জ্বালানি ব্যয় মানে তাড়াতাড়ি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। পক্ষান্তরে কম ভরের নক্ষত্র ট্রিলিয়ন বছর ধরে জ্বলবে যা মহাবিশ্বের বর্তমান অস্তিত্বের চেয়েও বেশি সময় ধরে হতে পারে। আর কিছু কিছু বৃহৎ নক্ষত্র বেঁচে থাকবে মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর; কারণ তাদের জ্বালানি ফুরিয়ে যায়।

 

নক্ষত্রের মৃত্যু

একটি নক্ষত্রের জীবনের শেষ প্রান্তে হাইড্রোজেন ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে হিলিয়াম তৈরি হতে পারে না এবং কেন্দ্রের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্রের পদার্থ ভেঙে যেতে শুরু করে। কিন্তু কেন্দ্রে চাপ বৃদ্ধির ফলে তাপমাত্রা এবং চাপও বৃদ্ধি পায়; ফলে নক্ষত্র ধীরে ধীরে ফুলে ওঠে।

একটি কম ভরের নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডল প্রসারিত হতে থাকবে যতক্ষণ না এটি একটি সাব-জায়ান্ট বা দৈত্যাকার নক্ষত্রে পরিণত হয় এবং কেন্দ্রে ফিউশন  প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম কার্বনে রূপান্তরিত হয়। কয়েক বিলিয়ন বছর পরে আমাদের সূর্যের ভাগ্যও এটি হবে।

কিছু দৈত্যাকার নক্ষত্র অস্থির এবং স্পন্দিত হতে শুরু করে, পর্যায়ক্রমে তাদের বায়ুমণ্ডলে স্ফীতি এবং নির্গমন চলতে থাকে। অবশেষে নক্ষত্রের বাইরের সমস্ত স্তর উড়ে যায়। তৈরি হয় ধূলিকণা এবং গ্যাসের একটি প্রসারিত মেঘ, যাকে বলা হয় গ্রহীয় নীহারিকা। ছবি নং- ৩ তেমন একটি উদাহরণ।

 

ছবি নং- ৩: একটি আদর্শ হেলিক্স নীহারিকা যা ৬৫০ আলোকবর্ষ দূরে কুম্ভ রাশিতে অবস্থিত। এটি NGC 7293 নামেও পরিচিত।

উৎস: NASA/JPL-Caltech 

 

বিস্ফোরনের পর নক্ষত্রটির যা অবশিষ্ট থাকে তা হল এর মূল অংশ যাকে বলা হয় সাদা বামন। এটি প্রায় পৃথিবীর আকারের একটি নক্ষত্রীয় সিন্ডার যা কোটি কোটি বছর ধরে ধীরে ধীরে শীতল হবে।

তবে একটি উচ্চ-ভরের নক্ষত্রের পরিণতি একটু ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। ফিউশন কার্বনকে অক্সিজেন, নিয়ন এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো ভারী উপাদানে রূপান্তরিত করে, যা ভবিষ্যতে কোরের জ্বালানী হয়ে উঠবে। এই প্রক্রিয়া কতকাল চলবে বা তা নির্ভর করে নক্ষত্রের ভরের উপর। বৃহত্তম নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন চলতে থাকে যে পর্যন্ত না সিলিকন লোহায় মিশে যায়। 

ফিউশন প্রক্রিয়াগুলি এমন শক্তি উৎপন্ন করে যা কোরকে ভেঙে পড়া থেকে বিরত রাখে; কিন্তু প্রতিটি নতুন জ্বালানির ব্যবহার নক্ষত্রের মৃত্যুকে এগিয়ে নিতে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর সময় লাগে।

সিলিকন যখন লোহায় মিশে যায়, তখন কয়েক দিনের মধ্যে তারার জ্বালানিও শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো লোহাকে কিছু ভারী উপাদানে মিশিয়ে দেওয়া; কিন্তু এটি করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়।

নক্ষত্রের লৌহ কেন্দ্র ভেঙে পড়ে যতক্ষণ না নিউক্লিয়াসের মধ্যেকার বল ব্রেকে চাপ দেয়। এই পরিবর্তনের ফলে একটি শক ওয়েভ তৈরি হয় যা নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে বাইরের দিকে ধাবিত হয়। ফলাফল হলো একটি বিশাল বিস্ফোরণ; যাকে সুপারনোভা বলা হয় (ছবি নং ৪)। কেন্দ্রটি অবিশ্বাস্যভাবে ঘন অবশিষ্টাংশ টিকে থাকে একটি নিউট্রন তারকা অথবা একটি কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে।

সুপারনোভা এবং অন্যান্য নক্ষত্রীয় ঘটনা দ্বারা মহাবিশ্বে নিক্ষিপ্ত উপাদান ভবিষ্যতের আণবিক মেঘকে সমৃদ্ধ করবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের নক্ষত্রের সাথে একীভূত হবে।

 

ছবি নং- ৪: ১৫৭২ সালে দেখা একটি সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ।

উৎস: X-ray: NASA/CXC/RIKEN & GSFC/T. Sato et al; Optical: DSS

 

 

প্রশ্নোত্তর

নক্ষত্রের জীবনকাল কতটুকু?

নক্ষত্রের জীবনকাল তার আকার ও জ্বালানির পরিমাণের উপর নির্ভর করে। সাধারণত, ছোট নক্ষত্রের জীবনকাল কয়েক বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন বছর হতে পারে। বড় নক্ষত্রের জীবনকাল হয় প্রায় মিলিয়ন থেকে কয়েক হাজার বছর।

 

নক্ষত্রের মৃত্যুর পর কি ঘটে?

বড় আকারের নক্ষত্রের মৃত্যুতে তারা সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হয়। পরে কৃষ্ণগহ্বর বা নিউক্লিয়ার সাদা বামন তৈরি হয়। ছোট আকারের নক্ষত্রগুলো সাদা বামন বা ধূমকেতুতে রূপান্তরিত হতে পারে।

 

পৃথিবী থেকে নক্ষত্রগুলো কিভাবে দেখা যায়?

পৃথিবী থেকে নক্ষত্রগুলো দেখা যায় আকাশের বিশেষ অংশে যেখানে বাতাসের ধূলিকণা কম। বিভিন্ন ঋতু এবং রাতের সময় অনুযায়ী বিভিন্ন নক্ষত্র দেখা যায়।

 

নক্ষত্রের রঙের অর্থ কী?

নক্ষত্রের রঙ তার তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। নীল নক্ষত্র সবচেয়ে উষ্ণ, লাল নক্ষত্র তুলনামূলভাবে কম তাপমাত্রার। রঙের মাধ্যমে তাপমাত্রার প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।

 

নক্ষত্রের আকার কত বড় হতে পারে?

নক্ষত্রের আকার বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কিছু নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে অনেক ছোট, আবার কিছু কিছু সূর্যের চেয়ে অনেক বিশাল হতে। উদাহরস্বরূপ, UY Scuti হলো একটি লাল অতিদানব নক্ষত্র যার ব্যাসার্ধ আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ১,৭০০ গুণ বড়। 

 

নক্ষত্রের মধ্যে কী ধরনের জৈব উপাদান পাওয়া যায়?

মহাকাশে বিভিন্ন ধূলিকণার মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও অন্য মৌলিক উপাদান পাওয়া যায়; যা ভবিষ্যতে জীবনের জন্য উপকারী হতে পারে।

 

মহাকাশে নতুন নক্ষত্রের জন্মের জন্য কোন উপাদান প্রয়োজন?

নতুন নক্ষত্রের জন্মের জন্য প্রয়োজন ঘন গ্যাস ও ধূলিকণা। বিশেষ করে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস, যা একত্রিত হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন শুরু করে।

 

নক্ষত্রের মৃত্যু মহাবিশ্বের জন্য কি ধরনের প্রভাব ফেলে?

নক্ষত্রের মৃত্যু মহাবিশ্বের ধ্বংস বা পুনর্জন্মের প্রক্রিয়ার অংশ। সুপারনোভা মহাকাশে মৌলিক উপাদানের বিতরণ করে, যা ভবিষ্যত নক্ষত্র ও গ্রহের গঠনে সহায়তা করে। এটি মহাবিশ্বের জৈব উপাদান বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে।

 

সারাংশ

নক্ষত্রের জন্ম হয় গ্যাস ও ধূলিকণার ঘনকরণে। যখন তারা তাপ ও চাপ বৃদ্ধি করে নিউক্লিয়ার ফিউশন শুরু করে তখন জন্ম নেয় নতুন নক্ষত্র। তাদের জীবনকাল আকার ও জ্বালানির উপর নির্ভর করে। বড় নক্ষত্রের জীবনকাল কম এবং ছোট নক্ষত্রের জীবনকাল বেশি। মৃত্যুর সময় বড় নক্ষত্র সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হয়, পরে কৃষ্ণগহ্বর বা সাদা বামনে রূপ নেয়। ছোট নক্ষত্র ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়।