কার্টহুইল বা চাকার মতো ছায়াপথঃ অসীমের পথে চোখ

Category: Space & Astronomy | Tags: No tags

Author: Jatish Chandra Biswas | Published on: August 7, 2025, 9:13 p.m.


ছোটবেলা দেখতাম ধান বোঝাই গাড়ী মহিষ বা গরু টেনে নিয়ে যাচ্ছে (ছবি নং- ১)। চাকার ক্যাড় ক্যাড় শব্দ অনেক দূর থেকেই শুনতে পেতাম। যে হালট দিয়ে মহিষ তা টেনে নিয়ে যেতো বর্ষাকালে তা থাকতো কাদাময়, থকথকে। চাকা ডেবে গেলে গাড়োয়ানের চিকিৎকার ও চেচামেচি ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে কার্টহুইল গ্যালাক্সির সম্পর্ক।

ছবি নং-১: মহিষ ও গরু টানা গাড়ি

 

কার্টহুইল ছায়াপথটি দেখতে কেমন?

কার্টহুইল ছায়াপথটি দেখতে অনেক মহিষ বা গরুর টানা গাড়ির চাকার মতো (ছবি নং-২)। তবে এই ছায়াপথটির মাঝখানটি দেখতে অনেকটা ষাঁড়ের চোখের মতো। আসলে এর প্রায় মাঝখান দিয়ে অন্য একটি ছোট ছায়াপথ ঢোকে গেছে (ছবি নং-৩)।

 ছবি নং-২: কার্টহুইল গ্যালাক্সি যেন কাঠের তৈরি চাকা 

 

 

ছবি নং-৩: কার্টহুইল গ্যালাক্সির কেন্দ্র যেন ষাঁড়ের চোখ 

 

কার্টহুইল ছায়াপথটি বৈশিষ্ট কেমন?

মাটির প্রথিবী ছেড়ে চলুন এখন আমরা এখন মহাশূন্যে চলে যাই- মিলিয়ন মিলিয়ন আলোবর্ষ দূরে। আজকে আমি যে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ নিয়ে কথা বলবো তার নাম কার্টহুইল গ্যালাক্সি। এটি প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া উচ্চ-গতির একটি সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়। বিরল দৃশ্যের এই গ্যালাক্সিটি স্কাল্পটার নক্ষত্রমণ্ডলে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

কার্টহুইল ছায়াপথের গঠন 

কার্টহুইল এবং এর সহযোগী ছায়াপথগুলির চিত্রটি (ছবি নং- ৪) ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা (NIRCam) এবং মিড-ইনফ্রারেড ইন্সস্টূমেন্ট (MIRI) থেকে নেওয়া। কার্টহুইল ছায়াপথটি দুটি বলয় দ্বারা গঠিত- একটি উজ্জ্বল অভ্যন্তরীণ বলয় এবং আরেটি বাইরের রঙিন বলয়। আর রয়েছে ছোট দুটি সহযোগী ছায়াপথ। কোটি কোটি বছর ধরে কার্টহুইল গ্যালাক্সি কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তার সুন্দর একটি নমুনা।

ছবি নং-৪: কার্টহুইল এবং এর সহযোগী ছায়াপথসমূহ 

 

গ্যালাক্টিক অংশসমূহে সংঘর্ষ ছায়াপথগুলির মধ্যে বিভিন্ন, ছোট ছোট ঘটনার একটি ক্যাসকেড সৃষ্টি করে; কার্টহুইলও এর ব্যতিক্রম নয়। সংঘর্ষটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ছায়াপথের আকৃতি এবং এর গঠনকে প্রভাবিত করেছিল।

কার্টহুইল গ্যালাক্সির দুটি বলয় সংঘর্ষের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে প্রসারিত; অর্থাৎ পুকুরের পানিতে একটি পাথর ছুঁড়ে ফেলার পরে যে রকমের তরঙ্গ তৈরি হয় সেরকম আরকি (ছবি নং: ৫)। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটিকে "বলয় গ্যালাক্সি" বলে অভিহিত করেন। 

 

ছবি নং- ৫: অনেকগুলো গ্যালাক্সির সাথে বৃহৎ আকৃতির বিকৃত কার্টহুইল গ্যালাক্সি 

 

গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অবস্থা

গ্যালাক্সিটির উজ্জ্বল কেন্দ্রে প্রচুর পরিমাণে উত্তপ্ত ধুলো রয়েছে, যার উজ্জ্বলতম অঞ্চলগুলিতে  তরুণ নক্ষত্র গুচ্ছের বিশাল আবাসস্থল। বাইরের বলয়, যা প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন বছর ধরে প্রসারিত হয়েছে, সেখানে নক্ষত্রের গঠন এবং সুপারনোভা প্রাধান্। এই বলয়টি প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে এটি চারপাশের গ্যাসের মধ্যে মিশে যায় এবং নক্ষত্রের গঠন শুরু করে।

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ সহ অন্যান্য টেলিস্কোপগুলি পূর্বে কার্টহুইল পরীক্ষা করেছে। কিন্তু গ্যালাক্সিটি রহস্যে ঢাকা; ধূলোর পরিমাণ এতো বিশাল যে একে ঠিক মতো দেখা যায় না। তবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সক্ষমতা আছে ইনফ্রারেড আলো সনাক্ত করার। তাই কার্টহুইলের প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য উন্মোচিত হয়েছে ((ছবি নং- ৬)।

 

ছবি নং- ৬: কার্টহুইল গ্যালাক্সির বলয় (opo9636a1 এবং opo9636a2)

 

ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরায় গ্যালাক্সিটির রূপ

ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা (NIRCam) ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রন পর্যন্ত নিয়ার-ইনফ্রারেড রেঞ্জে পর্যবেক্ষণ করে আলোর গুরুত্বপূর্ণ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যসমূহ দেখতে পায় যা দৃশ্যমান আলোতে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ফলে অধিক সংখ্যক নক্ষত্র দেখা যায়। তরুণ নক্ষত্রগুলো যারা বাইরের বলয়ে তৈরি হচ্ছে তা ইনফ্রারেড আলোতেও ধরা পড়ে (ছবি নং-৭)।

ছবি নং- ৭: অগ্নিগর্ভ কার্টহুইল গ্যালাক্সি 

 

NIRCam তথ্য প্রকাশ করে নীল, কমলা এবং হলুদ রঙের মাধ্যমে। গ্যালাক্সিটিতে অনেকগুলি পৃথক পৃথক নীল বিন্দু দেখা যাচ্ছে, যা নির্দেশ করে পৃথক পৃথক নক্ষত্র গঠনের অঞ্চল। NIRCam পুরাতন নক্ষত্রের সংখ্যার সুষম বন্টন বা আকৃতি এবং কেন্দ্রের ঘনত্বের সাথে বাইরের অনিয়মিত আকৃতির তরুণ নক্ষত্রের সংখ্যার সাথে পার্থক্যও প্রকাশ করে।

গ্যালাক্সিতে থাকা ধুলো সম্পর্কে সুক্ষ সুক্ষ বিষয়ে জানার জন্য ওয়েবের মিড-ইনফ্রারেড ইন্সট্রমেন্ট (MIRI) প্রয়োজন। ছবিতে MIRI এর তথ্য লাল রঙে দেখানো হয়েছে। এটি কার্টহুইল গ্যালাক্সির মধ্যে হাইড্রোকার্বন, ন্যান্য রাসায়নিক যৌগ সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি এবং সিলিকেট ধুলার অংশও প্রকাশ করেছে। এই অঞ্চলগুলি স্পাইরাল স্পোকের একটি সিরিজ তৈরি করে যা মূলত গ্যালাক্সিটির কঙ্কাল। এই স্পোকগুলি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হাবল পর্যবেক্ষণগুলিতেও ছিল। তবে এখন তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে (ছবি নং- ৭)।

ওয়েবের পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় যে কার্টহুইল গ্যালাক্সিটি খুবই ক্ষণস্থায়ী পর্যায়ে রয়েছে। সংঘর্ষের আগে গ্যালাক্সিটি, যা সম্ভবত মিল্কিওয়ের মতো একটি স্বাভাবিক সর্পিল ছায়াপথ ছিল, রূপান্তরিত হতে থাকবে। ওয়েব আমাদের কার্টহুইলের বর্তমান অবস্থার একটি দৃশ্যপট দিলেও অতীতে এই ছায়াপথে কী ঘটেছিল এবং এটি ভবিষ্যতে কীভাবে বিকশিত হবে তারওর একটি দিক নির্দেশনা দেয় (আরো জানতে NASA এর রিপোর্ট দেখুন; https://www.nasa.gov/universe/webb-captures-stellar-gymnastics-in-the-cartwheel-galaxy/)

 

FAQs

কার্টহুইল গ্যালাক্সির আবিষ্কার কবে এবং কার মাধ্যমে হয়?

কার্টহুইল গ্যালাক্সি প্রথম ১৯৪১ সালে আবিষ্কৃত হয়। এটি মূলত হাবল টেলিস্কোপের ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়।

 

কার্টহুইল গ্যালাক্সির মধ্যে কেমন ধরনের নক্ষত্র রয়েছে?

এই গ্যালাক্সিতে বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্র থাকতে পারে। তবে মূলত এর কেন্দ্রের অংশে পুরোনো ও বড় নক্ষত্রের সংখ্যা বেশি।

 

কার্টহুইল গ্যালাক্সির আকার কত বড়?

এটি সাধারণত প্রায় ১৫০০০০ আলোকবর্ষ প্রশস্ত হয়, তবে এর আকার কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।

 

কার্টহুইল গ্যালাক্সির সৌন্দর্য্য কেন বিশেষ ধরনের?

এর চাকার মত নকশা ও স্পাইরাল বহিস্থ গোলক এর সৌন্দর্য্যকে অসাধারণ করে তোলে এবয় যা দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

 

ভবিষ্যতে কার্টহুইল গ্যালাক্সির কি গবেষণা পরিকল্পনা রয়েছে?

হাবল টেলিস্কোপ ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এর গঠন, গতি, ও মহাজাগতিক অবস্থা আরও বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

 

সারাংশ

১৯৪১ সালে ফ্রিটজ্ জুইকির (Fritz Zwicky) আবিষ্কার করা কার্টহুইল গ্যালাক্সি প্রায় ৫০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি বিচিত্র ধরনের গ্যালাক্সি। এটি প্রায় ১৫০,০০০ আলোকবর্ষ ধরে ছড়িয়ে রয়েছে। গবেষকরা বিশ্বাস করেন এটি একসময় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো একটি সর্পিল গ্যালাক্সি ছিল। কিন্তু তারপর একটি ছোট গ্যালাক্সি একে তীব্র বেগে আঘাত করে। ফলে গ্যালাক্সিতে থাকা নক্ষত্র এবং গ্যাস তরঙ্গের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে দুটি বলয় নিয়ে অর্থাৎ একটা রিং-এর ভিতর আরেকটি রিং নিয়ে সেজেছে।