ধূমকেতু ও গ্রহাণু: মহাবিশ্বের রহস্যময় ছোট ছোট অভিযাত্রী

Category: Science & Environment | Tags: Comet Space Science

Author: Jatish Chandra Biswas | Published on: July 15, 2025, 3:27 a.m.


মহাকাশের ছোট ছোট অভিযাত্রী

মহাবিশ্বের অসীম বিস্তৃতিতে অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র, এবং অজস্র রহস্যের মাঝে কিছু ছোট ছোট পাথর ও বরফের গুঁড়ো রয়েছে— যা আমরা কমেটস (ধূমকেতু) ও এসটেরয়ডস (গ্রহাণু) নামে জানি। এই দুটি মহাকাশের অদ্ভুত ও রহস্যময় সৃষ্টি- তারা নিজেদের বিশেষ গঠন ও গতি দিয়ে মহাবিশ্বের এক অনন্য অংশ।

ধূমকেতু ও গ্রহাণুগুলো যেন মহাকাশের ছোট ছোট অভিযাত্রী। তারা বিভিন্ন পথে ভ্রমণ করে আবার কখনোবা অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার কখনো ফিরে আসে মহাবিশ্বের নানা কোণে। থাইতো তারা এতো আকর্ষণীয়!

 

ধূমকেতু

ধূমকেতু মূলত বরফ, ধূলিকণা, ধূসর এবং ধাতব পদার্থের সংমিশ্রণ। এই বরফের গুঁড়ো গ্যাসের মতো ধোঁয়া বা লেজ তৈরি করে, যখন তারা সূর্যের কাছাকাছি আসে।

ধূমকেতু মূল অংশের চারপাশে একটি উজ্জ্বল লেজ তৈরি হয়, যা সূর্য থেকে আসা আলো ও গ্যাসের বিকিরণে তৈরি। এই লেজটি সাধারণত অনেক লম্বা ও ঝুলন্ত হয়।

ধূমকেতু মূলত সূর্য থেকে দূরে থাকলেও, যখন তারা সূর্যের কাছাকাছি আসে, তখন তাদের লেজ এবং উজ্জ্বলতা বেশি দেখা যায়। সাধারণত কুইপার, হেলিওন ও হ্যালির মতো ধূমকেতু দেখা যায়। নির্বাচিত কয়েকটি ধূমকেতু দেখানো ও সংক্ষেপে বর্ণনা।

 

হেল-বপ (Hale-Bopp)

ধূমকেতু হেল-বপ (C/1995 O1) ২৩শে জুলাই, ১৯৯৫ সালে দুইজন স্বাধীন পর্যবেক্ষক, অ্যালান হেল এবং থমাস বপ আবিষ্কার করেন। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের দ্বারা তোলা হয়েছে। ঘূর্ণায়মান ধূমকেতু থেকে পদার্থগুলো "পিনহুইল" প্যাটার্নে নির্গত হয়েছে (ছবি নং-১)।

একে ১৯৯৭ সালের বড় ধূমকেতু বলা হয়; কারণ C/1995 O1 (হেল-বপ) হল একটি বৃহৎ ধূমকেতু যার নিউক্লিয়াস প্রায় ৩৭ মাইল ব্যাস বিশিষ্ট।

বিশাল আকারের কারণে, এই ধূমকেতুটি ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে ১৮ মাস যাবৎ খালি চোখে দৃশ্যমান ছিল। সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে হেল-বপের প্রায় ২,৫৩৪ বছর সময় লাগে। হেল-বপ শেষবার ১ এপ্রিল, ১৯৯৭ তারিখে পেরিহেলিয়নে (সূর্যের সবচেয়ে কাছের অবস্থান) পৌঁছেছিল (আরো জানতে পড়তে পারেন, NASA)।

 

হায়াকুতাকে ধূমকেতু (Hyakutake)

এটি ১৯৯৬ সালের ৩০শে জানুয়ারী জাপানি অপেশাদার জ্যোতির্বিদ হায়াকুতাকে ইউজি বড় দূরবীন ব্যবহার করে আবিষ্কার করেছিলেন। নীল লম্বা আকর্ষনীয় লেজ আছে এর (ছবি নং-১)

সেই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে খালি চোখে দৃশ্যমান হলেও, মার্চ মাসে এটি দর্শনীয় হয়ে ওঠে তার লম্বা নীল আয়ন (প্লাজমা) লেজ এবং খাটো কিন্তু প্রশস্থ সাদা ধুলোর লেজের জন্য (এই ধূমকেতু সম্মর্কে আরো জানতে পারেন Britannica থেকে)। 

ছবি নং-১. Hale-Bopp comet, Hyakutake comet, Comet Borisov, Comet ISON, Halley's comet, and C/2022 E3 
 

বরিসভ ধূমকেতু (Borisov comet)

হাবল টেলিস্কোপ এই ধূমকেতুর ছবিটি ১২ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখে তুলেছিল। তখন  ২আই/বরিসভ ধূমকেতুটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৬০ মিলিয়ন মাইল (৪১৮ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে ছিল। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ছিল ঘনীভূত ধুলো; কিন্তু নিউক্লিয়াসটি এত ছোট ছিল যে, হাবল টেলিস্কোপ তা দেখতে পায়নি (ছবি নং-১)।

2I/বরিসভ হল প্রথম নিশ্চিত আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতু। এটি ক্রিমিয়ার অপেশাদার জ্যোতির্বিদ গেনাডি বোরিসভ (Gennady Borisov) ৩০ আগস্ট, ২০১৯ তারিখে আবিষ্কার করেছিলেন এবং তা দ্রুত সারা বিশ্বের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

বিশ্বব্যাপী অপেশাদার এবং পেশাদার জ্যোতির্বিদগণ এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পর নিশ্চিত করেন যে এটি আমাদের সৌরজগতের বাইরে থেকে এসেছিল।

নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ২০১৯ সালের অক্টোবর এবং ডিসেম্বরে ধূমকেতু ২আই/বরিসভের ছবি ধারণ করেছিল, যখন এটি আমাদের সৌরজগতের মধ্য দিয়ে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১,১০,০০০ মাইল (১,৭৭,০০০ কিলোমিটার) বেগে ধাবিত হয়েছিল।

২০২০ সালের মার্চ মাসে, হাবল টেলিস্কোপ ব্যবহারকারী বিজ্ঞানীরা ধূমকেতুর চেহারায় একটি স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করেন- আগে ধারনকৃত চিত্রগুলিতে একক উজ্জ্বল অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র থাকলেও পরিবর্তী ছবিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, নিউক্লিয়াস থেকে একটি খণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে (আরো জানতে দেখুন, NASA)।

 

ইসন ধূমকেতু (ISON)

রাশিয়ার কিসলোভডস্কে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক ০.৪-মিটার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে রাশিয়ান জ্যোতির্বিদ ভিটালি নেভস্কি এবং আর্টিওম নোভিচোনক ধূমকেতুটি আবিষ্কার করেন। আন্তর্জাতিক সায়েন্টিফিক অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক রাতের আকাশ জরিপ করে এই ধূমকেতুটি (C/2012 S1; ISON) আবিষ্কারকার করেন বলে একে ISON বলা হয় (ছবি নং-১)।

ISON হল ১০টি দেশের একটি পর্যবেক্ষণাগারের দল যারা মহাকাশে বস্তুর সনাক্তকরণ, পর্যবেক্ষণ এবং  গতিপথ নির্ণয় করার জন্য সংগঠিত হয়েছে। নেটওয়ার্কটি রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসের ব্যবস্থাপনায় কেলডিশ ইনস্টিটিউট অফ অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স দ্বারা পরিচালিত হয় (আরো জানতে চাইলে দেখতে পারেন NASA এর রিপোর্ট)।

 

হেলির ধূমকেতু (Halley’s comet)

হ্যালিকে প্রায়শই সবচেয়ে বিখ্যাত ধূমকেতু বলা হয় কারণ এই ধূমকেতুর মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো বুঝতে পারেন যে, ধূমকেতুরা আমাদের রাতের আকাশে বারবার দর্শনার্থী হতে পারে। তদুপরি এর রয়েছে সুন্দর লম্বা লেজ (ছবি নং-১)। এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ধূমকেতুর উপস্থিতিকে ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণের সাথে যুক্ত করেছেন।

হ্যালিকে শেষবার পৃথিবীর আকাশে দেখা যায় ১৯৮৬ সালে এবং মহাকাশে এটির সাথে একটি আন্তর্জাতিক মহাকাশযানের দেখা হয়েছিল। এটি ৭৬ বছর পর ২০৬১ সালে আবার সূর্যের চারপাশে ফিরিতি যাত্রায় দেখা যাবে (কৌতুল মিটানের জন্য দেখুন NASA, এর রিপোর্ট)।

 

ই-৩ ধূমকেতু (C/2023 E3 comet)

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ধূমকেতুটি প্রথম ২০২২ সালের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আবিষ্কার করেন। এর সুন্দর লম্বা নীলাভ লেজ রয়েছে (ছবি নং-১)। ধূমকেতুটি আমাদের সৌরজগতকে ঘিরে থাকা বরফের বস্তুর একটি বিশাল মেঘ, উর্ট ক্লাউড থেকে এসেছে বলে মনে করা হয় See more at BGR)।

 

বোরেলি ধূমকেতু (Borrelly comet)

নাসার ডিপ স্পেস-১ মহাকাশযানটি ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০০১ তারিখে ধূমকেতু বোরেলির মুখোমুখি হয় (ছবি নং-২)। এটা তখন প্রতি সেকেন্ডে ১০ মাইল (১৬.৬ কিলোমিটার) গতিতে (৩৭,০০০ মাইলেরও বেশি, বা প্রায় ৬০,০০০ কিলোমিটার) গতিতে উড়ছিল। ডিপ স্পেস-১ ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসের ১,৩৪৯ মাইল (২,১৭১ কিলোমিটার) মধ্যে ভ্রমণ করেছিল (আরো জনার জন্য পড়তে পারেন NASA এর সংকলণ) ।

 

নিউওয়াইজ ধূমকেতু (NEOWISE comet)

২৪শে জুন, ২০২০ তারিখে ধূমকেতুটি যখন সূর্যের কাছাকাছি এসেছিল তখন NASA-এর Solar and Terrestrial Relations Observatory বা STEREO দ্বারা NEOWISE-এর ছবিটি ধারণ করা হয়েছিল (ছবি নং-২)।

একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ অভিযানের কারণে ধূমকেতুটি STEREO এর Heliospheric Imager-এ দৃশ্যমান হয় 24 জুন ২০২০ সনে। বেটেলজিউস নক্ষত্রটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য STEREO ঘুরে গিয়েছিল ১৮০-ডিগ্রি। ধূতকেতুটির উজ্জ্বলতার তারতম্য কয়েক মাস ধরে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলী করে তুলে (আরো পড়তে vist NASA website (https://science.nasa.gov/blogs/the-sun-spot/2020/07/14/nasas-stereo-sees-comet-neowise/)।

 

ছবি নং-২. Borrelly comet, NEOWISE comet, interstellar comet 3I/ATLAS, and Lemmon comet

 

 

এটলাস ধূমকেতু (ATLAS comet

চিলির রিও হুর্তাদোতে নাসার অর্থায়নে পরিচালিত ATLAS (Asteroid Terrestrial-impact Last Alert System) সার্ভে টেলিস্কোপ) ১ জুলাই, ২০২৫ তারিখে আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থান হতে উৎপন্ন একটি ধূমকেতুর পর্যবেক্ষণের কথা প্রথম জানায়।

ধনু রাশির (Sagittarius) দিক থেকে আগত এই আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূমকেতুটির আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয়েছে 3I/ATLAS (ছবি নং-২)। এটি বর্তমানে প্রায় ৪২০ মিলিয়ন মাইল (৬৭০ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত (বিস্তারিত জানতে NASA website visit করতে পারেন)।

 

লেমন ধূমকেতু (Lemmon comet)

২০২৫ সালের অক্টোবরের শেষে ধূমকেতু লেমন পৃথিবীর ০.৬ AU (the comet's closest approach to the Sun is 0.6 times the average distance between the Earth and the Sun) এর কাছাকাছি চলে আসবে। ছবি নং-২ দেখুন ধারনা পাওয়ার জন্য। তখন উত্তর গোলার্ধের পর্যবেক্ষকগন সন্ধ্যার আকাশে এই ধূমকেতুকে দেখতে পারবেন। তবে অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে ধূমকেতুটি প্রায় ৮ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে এবং দূরবীনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হতে পারে (আরো জানতে দেখুন Starwalk)।

 

এসটেরয়ডস (গ্রহাণু)

এসটেরয়ডস বা গ্রহাণু বা ক্ষুদ্র গ্রহ প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের সৌরজগতের প্রাথমিক গঠনের সময় থেকে আছে। মূলত পাথর, ধাতু, ধূলিকণা ও অন্যান্য উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত। এগুলো খুবই কঠিন ও ক্ষুদ্র, যা মহাকাশে একত্রে বা এককভাবে ছড়িয়ে থাকে। বেশিরভাগ গ্রহাণু মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মাঝামাঝি মূল গ্রহাণু বেল্টের মধ্যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে থাকে।

সৌরজগতের বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের মাঝে যে অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট রয়েছে খেখান থেকে গ্রহাণু কখনো কখনো পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে পারে।

নাসা পৃথিবীর কাছাকাছি বস্তু বিশেষত গ্রহাণু নিয়ে স্টাডি এবং পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাসার প্ল্যানেটারি ডিফেন্স কোঅর্ডিনেশন অফিস (NASA's Planetary Defense Coordination Office) গ্রহাণু ট্র্যাক করা এবং সম্ভাব্য প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার কৌশল তৈরির জন্য দায়ী।

প্রায় ১৬টি গ্রহাণু সম্পর্কে নাসার কাছে তথ্য আছে। তবে এখানে আমি নির্বাচিত কয়েকটি গ্রহাণুর বর্ণনা করবো-

 

ডোনাল্ডজনসন (Donaldjohanson)

গ্রহাণু ডোনাল্ডজোহানসন হল একটি  অনন্য আকৃতির টুকরো যা প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে তৈরি হয়েছিল (ছবি নং-৩)। এটি মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী প্রধান গ্রহাণু বেল্টে অবস্থিত।

বৃহস্পতির ট্রোজান গ্রহাণু অন্বেষণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় নাসার লুসি মহাকাশযান ডোনাল্ডজোহানসনকে কাছ থেকে দেখে ২০ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে। মহাকাশযানটি গ্রহাণুর প্রায় ৬০০ মাইল (৯৬০ কিমি) কাছে ছিল (আরো জানতে দেখুন, NASA) 

ছবি নং-৩: ডোনাল্ডজনসন, ২০২৪ ওয়াইআর৪, সাইকি, বেন্নু, ডিনকিনেশ ও সেলাম, এবং আইডা 

 

গ্রহাণু ২০২৪ ওয়াইআর৪ (Asteroid 2024 YR4)

২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আবিষ্কৃত গ্রহাণু হলো ২০২৪ YR4 (ছবি নং-৩)। প্রথমে ভাবা হয়েছিল যে, এটি ২০৩২ সালে পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে। তবে সে ভাবনা কেটে গেছে।

আগে ভাবা হয়েছিল যে, গ্রহাণুটি চাঁদকে আঘাত করতে পারে। তবে অধিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ঘোষণা করা হয় যে, ২০৩২ সালে চাঁদে আঘাত করার সম্ভাবনা মাত্র শতকার ৪ ভাগ।

প্রথম দিকে এর দৈর্ঘ ১৩১-২৯৫ ফুট (৪০-৯০ মিটার) বলা হয়েছিল। তবে এখন বলা হচ্ছে এর দৈর্ঘ  ১৭৪-২২০ ফুট (৫৩-৬৭ মিটার), যা একটি ১৫ তলা ভবনের আকারের সমান কৌতুলি পাঠক দেখতে পারেন, NASA website)। 

 

সাইকি (Psyche asteroid)

প্রধান গ্রহাণু বেল্টের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তুগুলির মধ্যে একটি হলো সাইকি (ছবি নং-৩)। এটি একটি বিশাল ধাতু সমৃদ্ধ গ্রহাণু এবং সূর্য থেকে পৃথিবীর তুলনায় প্রায় তিনগুণ দূরে অবস্থিত।

এর আকুতি অনেকটা গোলআলুর মতো। এটিকে যদি বিষুবরেখায় অনুভূমিকভাবে অর্ধেক করে কাটা হয়, তবে প্রশস্ততম বিন্দুতে এর প্রস্থ হবে ১৭৩ মাইল (২৮০ কিলোমিটার) এবং দৈর্ঘ ৪৪ মাইল (২৩২ কিলোমিটার)। এর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল ৬৪,০০০ বর্গমাইল (আরো জানেতে দেখুন NASA).

 

বেন্নু (Bennu asteroid)

গ্রহাণু বেন্নু প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয় বলে ধারণা। তবে এক বিশাল সংঘর্ষের পর প্রায় ১ থেকে ২ বিলিয়ন বছর আগে ধ্বংসস্তূপের অবশিষ্টাংশের একটি ছোট অংশ একত্রিত হয়ে বেন্নু গঠিত হয়েছে (ছবি নং-৩)।

এটি মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝামাঝি প্রধান গ্রহাণু বেল্টে তৈরি হতে পারে এবং পরে পৃথিবীর খুব কাছে চলে এসেছে। বেন্নু প্রতি ৬ বছর অন্তর পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে। তখন আমাদের গ্রহ থেকে এটি প্রায় ১৮৬,০০০ মাইল (২৯৯,০০০ কিলোমিটার) দূরে থাকে (NASA আরো বিস্তাতিভাবে বর্ণনা করেছে)।

 

ডিনকিনেশ ও সেলাম গ্রহাণু (Dinkinesh and Selam asteroid)

গ্রহাণু ডিনকিনেশ আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৯ সনে এবং এর একটি অস্থায়ী নাম দেয়া হয় ১৯৯৯ ভিডি৫৭। বেশ কয়েক বছর পরে এটি একটি সরকারী সংখ্যা (১৫২৮৩০) অর্জন করে তবে তখনো নামকরন করা হয়নি। গ্রহাণুটির ছবি দেখুন ছবি নং-৩ এ।

তবে লুসির দল (Lucy team) যখন এই গ্রহাণুটিকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে শনাক্ত করে তখন তারা এর নামকরন করেন। মিশন দলটি তিন বছর বয়সী এক মেয়ের জীবাশ্মের নামানুসারে উপগ্রহটির নামকরণ করে সেলাম, যার অর্থ আমহারিক ভাষায় শান্তি (আরো দেখেতে পারেন, NASA website)।

 

আইডা গ্রহাণু (Ida asteroid)

আইডা হলো দ্বিতীয় গ্রহাণু যা কোনও মহাকাশযান পরিদর্শন করেছে। প্রথমবারের মতো  আবিস্কৃত হয় যে, এর একটি  নিজস্ব চাঁদ আছে (ছবি নং-৩)। পরবর্তীতে চাঁদের নামকরণ করা হয় ড্যাকটাইল (Dactyl)।

১৯৯৩ সালের ২৮শে আগস্ট নাসার গ্যালিলিও মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহের দিকে যাওয়ার পথে প্রায় ১,৫০০ মাইল (প্রায় ২,৪০০ কিলোমিটার) দূরে থাকা অবস্থায় আইডার পাশ দিয়ে উড়ে যায়।

পাঁচ মাসেরও কিছু বেশি সময় পরে গ্যালিলিওর পাঠানো ছবিগুলো বিশ্লেষনের সময় বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করলেন যে গ্রহাণুর সাথে একটি ক্ষুদ্র চাঁদ আছে (আরো জানতে দেখুন NASA)

 

মহাবিশ্বে ভ্রমণ ও হারানোর গল্প

কমেটস ও এসটেরয়ডসের চলাচল অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। তারা তাদের নিজস্ব পথে চলে। কখনো সূর্যকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। আবার কখনো নিজেদের পথ হারিয়ে যায়, বিশেষ করে মহাকাশের ডিপ স্পেসের অজানা গভীরে। ডিপ স্পেসে চলে গেলে কোন যোগাযোগ বা নজরদারি পৌঁছায় না এবং সেখানে এই পাথরগুলো হারিয়ে যেতে পারে। এই গল্প মহাকাশের অজানা রহস্যেরই অংশ।

 

মহাকাশে ধূমকেতু ও এসটেরয়ডসের চলাচল

ধূমকেতুর চলাচল

কমেটস মূলত সূর্যকে ঘিরে একটি লম্বা পথ অনুসরণ করে চলে। যখন তারা সূর্যের কাছাকাছি আসে, তখন তাদের বরফ গলতে শুরু করে, গ্যাস ও ধূলিকণা বের হতে থাকে। এই গ্যাসের ফোটা ও ধূলিকণাগুলোর কারণে তাদের লেজ তৈরি হয়। কমেটসের গতি সাধারণত ধীরে ধীরে হলেও, সূর্যের কাছাকাছি আসার সময় দ্রুত হয়।

 

গ্রহাণুর চলাচল

অ্যাক্টেরয়ডসের গতি ও পথ অনেকটা অপ্রত্যাশিত। তারা অনেক সময় মহাকাশে গতি পরিবর্তন করে গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করে বা বাইরে চলে যায়। অনেক এসটেরয়ডস সূর্যকে ঘিরে কক্ষপথে চললেও কিছু ধাক্কা বা মহাকাশীয় শক্তির প্রভাবের কারণে তারা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে পারে। এই ধরণের পরিস্থিতি মহাকাশে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

 

মহাকাশের রহস্যময়তা ও বৈচিত্র্য

প্রতিটি ধূমকেতু ও এসটেরয়ডের গঠন ও পথ আলাদা। কিছু ধূমকেতু সৌরজগতের বাইরে থেকে আসে, আবার কিছু এসটেরয়ডস হঠাৎ করে মহাকাশে দেখা যায়। এই ছোট ছোট পাথরগুলো মহাকাশের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। তারা আমাদের মহাকাশের অজানা দিকের জানালা খোলে দেয় এবং আমাদের আরো জানার তৃষ্ণা জাগে।

 

প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন নং-১: ধুমকেতু সূর্যের কাছাকাছি গেলে কেন তার পিঠে আলোর ঝলকানি সৃষ্টি হয়?

উত্তর: ধুমকেতুর বরফ গলে গিয়ে ধূলিকণার সঙ্গে মিলিত হয় যা সূর্যর আলোতে প্রতিফলিত হয়ে আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করে। এছাড়াও সূর্যের তাপ ধুমকেতুর গ্যাস ও ধূলিকণাকে উত্তপ্ত করার ফলে আলোর ঝলকানি সৃষ্টি হয়।

 

প্রশ্ন নং-২: ধুমকেতুর কক্ষপথ কেন খুব উল্টাপল্টা বা অনিয়মিত?

উত্তর: ধুমকেতুর কক্ষপথ অনেক সময় অনিয়মিত বা খুব অ্যাকসেন্ট্রিক হতে পারে। কারণ এগুলোর কক্ষপথ অন্যান্য মহাকাশীয় দিক থেকে ধাক্কা বা ধূলিকণার কারণে পরিবর্তিত হতে পারে।

 

প্রশ্ন নং-৩: ধুমকেতু কোন নক্ষত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত?

উত্তর: ধুমকেতুর সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত হলো সূর্য। কারণ সূর্যের তাপে ধুমকেতুর বরফ গলে যায় ও আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করে।

 

প্রশ্ন নং-৪: এসটেরয়েডের গঠন ও ধুমকেতুর গঠনের মধ্যে কোনটি বেশি পুরোনো?

উত্তর: এসটেরয়েড (গ্রহাণু) মূলত পুরাতন গ্রহের ধাতব বা পাথুরে উপাদানের অবশিষ্টাংশ। পক্ষন্তরে, ধুমকেতু হলো মূলত বরফ ও ধূলিকণায় গঠিত এবং সূর্য থেকে দূরে থাকায় দীর্ঘকাল ধরে অটুট থাকে। তাই গ্রহাণুর গঠনকে পুরোনো বলে ধরা হয়।

 

প্রশ্ন নং-৫: কি কারণে কিছু কিছু ধুমকেতু দীর্ঘ সময় ধরে দেখা যায় আর কিছু দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়?

উত্তর: ধুমকেতুর কক্ষপথের প্রকৃতি ও সূর্য থেকে দূরত্বের উপর নির্ভর করে এদেরকে কতদিন দেখা যাবে। সূর্যের কাছাকাছি আসলে ধুমকেতুর গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে দীর্ঘ সময় দেখা যায়। আর দূরে থাকলে উৎপন্ন গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ কমে যায়; ফলে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়।

 

প্রশ্ন নং-৬: কোনও ধুমকেতু যদি সূর্যর দিকে ধাবিত হয় তবে তার অবস্থা কী হবে?

উত্তর: ধুমকেতু সূর্যর দিকে ধাবিত হলে তার বরফ গলে যায় গিয়ে comas ও tails তৈরি হয় এবং শেষে সূর্যর কাছাকাছি এসে গলে বা দেহে মিলিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তার আকার ও চেহারা পরিবর্তিত হয়।

 

প্রশ্ন নং-৭: ধুমকেতু ও এসটেরয়েডের অবসান বা ধ্বংসের সম্ভাব্য কারণগুলো কী?

উত্তর: ধুমকেতুর অবসান হতে পারে সূর্যে তাপ ও রেডিয়েশন দ্বারা তার বরফ গলে যাওয়ার কারণে। অন্যদিকে, এসটেরয়েড ধ্বংস হতে পারে মহাকাশের অন্য কোন গ্রহ বা গ্রহাণু দ্বারা আঘাতে বা মহাকাশীয় ধাক্কা থেকে।

 

উপসংহার

ধুমকেতু ও এসটেরয়ডস মহাকাশের অদ্ভুত ও রহস্যময় দুনিয়ার অংশ। এই ছোট পাথরগুলো মহাকাশের বিস্ময়, যাদের চলাচল এবং হারিয়ে যাওয়ার গল্প আমাদের মহাবিশ্বের অসীম গোপনীয়তা ও বিস্ময় প্রকাশ করে।

তারা মহাকাশের ইতিহাসের অমূল্য অংশ, যা আমাদের কৌতূহল জাগায় আরও বেশি জানার জন্য। ভবিষ্যতে আরো উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণায় হয়তো আমরা এই রহস্যের অনেকটাই উন্মোচন করতে পারবো।