হ্যাঁ, অবশ্যই মুক্তি পাওয়া সম্ভব ভেজাল/নকল ওষুধের দৌরাত্ব থেকে। আমাদেরকে ব্যবহার করতে হবে কিউআর কোড, আইওটি, ও হলোগ্রাম। তবে আসুন তার আগে আমরা জেনে নিই ভেজাল/নকল ওষুধের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে।
বিশ্বব্যাপী ভেজাল ওষুধের সমস্যা একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়, যা মানুষের জীবন এবং স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে, যেখানে সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি থাকায় ভেজাল ওষুধের বিস্তার দ্রুত হচ্ছে।
World Customs Organization এর মতে প্রায় ২০০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার মূল্যের ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয় যার মধ্যে শতকার প্রায় ৬৭ ভাগ মানব দেহের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
ক্যান্সার, এন্টিবায়োটিক সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ওষুধে ভেজাল প্রবেশের ফলে রোগীর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এটি সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য সেবাকে সংকটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সচেতনতার অভাবের কারণে ভেজাল ওষুধের বিস্তার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। নিচে কিছু দেশের নাম, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং এই সমস্যার কিছু তথ্যসহ তুলে ধরা হলো।
ভারত
ভারত বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদনে অন্যতম। এদেশে ওষুধের বড় বাজার রয়েছে। বাজারে ভেজাল/নকল ওষুধ শতকরা ২০-৩০ ভাগ পর্যন্ত বলে ধারণা করা হয়। তবে Indian Health Ministry এর মতে তা হলো শতকরা ৫ ভাগ (Singh, 2023; http://dx.doi.org/10.12944/CRJSSH.6.1.08)। গ্রামীণ এলাকায় এই সমস্যা বেশি। বিহার, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিম বাংলায় রয়েছে ভেজাল/নকল ওষুধের রমরমা ব্যবসা।
ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। Singh, 2017 এর মতে ভারত থেকে যে সকল ওষুধ রফতানি করা হয় তার একটা বড় অংশে রয়েছে ভেজাল/নকল ওষুধ। ফলে ভেজাল/নকল ওষুধের অবাধ প্রবেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
নাইজেরিয়া
UN Office on Drugs and Crime এর মতে সাব-সাহারান আফ্রিকায় বছরে পাঁচ লক্ষ লোক মারা যায় ভেজাল/নকল ওষুধ ব্যবহার করে। এর মধ্যে বেশি মৃত্যু হয় ভেজাল/নকল ম্যালেরিয়ার ওষুধের কারণে এবং এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে।
আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হলো নাইজেরিয়া। এদেশে স্বাস্থ্য সেবা খাতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নাইজেরিয়ায় ভেজাল/নকল ওষুধের বাজার অনেক বড়। গবেষণা মতে, দেশটির ওষুধের শতকরা প্রায় ৫০% ভাগ ভেজাল বা নকল।
তবে নাইজেরিয়ার The National Primary Healthcare Development Agency এর মতে ২০২২ সনে শতকরা ৭০% ভাগ নকল/ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছিল (https://www.thinkglobalhealth.org/ article/nigerias-counterfeit-drug-epidemic)। এই সমস্যা মূলত অবৈধ বিক্রেতা ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার কারণে বাড়ছে।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করছে ও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এদেশেও ভেজাল ও নকল ওষুধের সমস্যা রয়েছে। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে ভেজাল ওষুধের হার ছিল শতকরা ৫-১০ ভাগ। এদেশে ভেজাল/নকল ওষুধের বাজার প্রায় ২৫০০ কোটি টাকার (https://www.thedailystar.net/health/news/countering-counterfeit-medicine-bangladesh-2971806)।
পাকিস্তান
দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর দ্বারা চালিত। এদেশে অব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে ভেজাল/নকল ওষুধের সমস্যা রয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের বাজারে প্রায় শতকরা ১৫-২০ ভাগ ওষুধ ভেজাল/নকল। তবে ডন প্রত্রিকার তথ্য অনুযায়ী শতকরা ৮৫ ভাগ ভেজাল/নকল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে পাকিস্তানে। Drug Regulatory Authority of Pakistan এর মতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ নকল (https://www.dawn.com/news/1900212)।
উপরে উল্লিখি পরিস্থিতিগুলো মোকাবেলায় প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে True Marker, অর্থাৎ কিউআর কোড, ইউনিক নম্বরযুক্ত হলোগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। এই প্রযুক্তি ওষুধের মূল উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনকে স্বচ্ছ ও নিরাপদ করে তুলতে সক্ষম। এছাড়া Internet of Things (IoT) এবং ব্লক চেইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কিউআর কোডের মাধ্যমে প্রতিটি ওষুধের বিশদ তথ্য সংরক্ষণ সম্ভব। যেমন- উৎপাদন তারিখ, তৈয়ারকারী, মূল ওষুধের পরিমাণ, কতদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে, গুদামজাতের স্থান, ইত্যাদি। রোগী বা ক্রেতা সহজেই স্মার্ট মোবাইলের মাধ্যমে এই তথ্য যাচাই করতে পারে। এভাবে ভেজাল/নকল ওষুধ বিক্রি প্রতিহত করা সম্ভব।
ইউনিক নম্বরযুক্ত হলোগ্রাম ব্যবহার করলে প্রতিটি ঔষধের স্বতন্ত্র পরিচয় নিশ্চিত করা যায়। এটি কপিরাইট বা জাল কপি তৈরির চেষ্টা প্রতিরোধ করে। ফলে ভেজাল চক্র ভেঙে যায়।
উল্লিখিত প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি আরও কার্যকরভাবে মনিটরিং করতে পারে এবং অবৈধ বা ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে। এর ফলে বাজারে মানসম্পন্ন ওষুধের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে ও জনগণের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
অতএব, ভেজাল ওষুধের এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। True Marker কিউআর কোড ও ইউনিক নম্বরযুক্ত হলোগ্রাম প্রযুক্তি বাস্তবায়ন শুধুমাত্র উৎপাদন ও সরবরাহের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে না, বরং মানুষের জীবন রক্ষায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। এটি প্রত্যেক দেশের সরকারের জন্য এক জরুরি উদ্যোগ হবে যাতে আমরা একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বিশ্ব গড়তে পারি।
সুতরাং, আসুন আমরা উদ্যোগ নিই এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা বোঝার এবং এর মাধ্যমে ভেজাল/নকল মুক্ত, মানসম্পন্ন ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করার। এতে করে আমাদের সমাজের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি উন্নত হবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত হবে।